“বিশ্বকাপে ব্রাজিল”

“বিশ্বকাপে ব্রাজিল”

ফুটবলে বাঙ্গালিদের অন্যতম পছন্দের দল ব্রাজিল। ব্রাজিলের নাম বলতেই আমাদের মনে পরে পেলে, রোনালদো, রোনালদিনহোর নাম। তাদের খেলা এখনো চোখে ভেসে ওঠে বৃদ্ধ থেকে জোয়ান সবার। ব্রাজিল জাতীয় দল তাদের প্রথম খেলা শুরু করে ১৯১৪ সালে। আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা ফিফা’র সদস্যা হয় ১৯২৩ সালে। ১৯৩০ সালে উরুগুয়েতে আয়োজিত প্রথম বিশ্বকাপেই অংশগ্রহন করে ব্রাজিল। সেই যে শুরু এখনো চলছে ব্রাজিলের  জয়যাত্রা। ব্রাজিলই একমাত্র দল যারা কিনা ফিফা আয়োজিত সব গুলো বিশ্বকাপেই অংশগ্রহন করেছেন। জিতেছে ফুটবল বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ পাঁচটি ট্রফি সেই সাথে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ সবগুলো স্থানেরই স্বাদ গ্রহন করেছে ব্রাজিল। চলছে ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে শেষ ১৬ তে লড়ছে এখন ব্রাজিল। সেইসাথে চলুন জেনে আসি ব্রাজিলের বিশ্বকাপের অংশগ্রহনের যত ইতিহাসঃ

উরুগুয়ে বিশ্বকাপ (১৯৩০)  স্বাধীনতার শতবছর উপলক্ষ্যে উরুগুয়েকেই দেওয়া হয়েছিল প্রথম বিশ্বকাপের দায়িত্ব। উরুগুয়ে আয়োজিত প্রথম বিশ্বকাপই একমাত্র বিশ্বকাপ যেখানে কোন বাছাই পর্ব ছিল না। মোট তেরটি দল অংশ নিয়েছিল উরুগুয়ে বিশ্বকাপে। তারমধ্যে ব্রাজিলও একটি। প্রথম বিশ্বকাপে ব্রাজিল ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে। অভ্যন্তরীন কলহের কারনে ব্রাজিল মূল রিউ ডি জানেইরু থেকেই তাদের খেলোয়ারদের এই প্রতিযোগিতায় পাঠিয়েছিল। তাই তাদের সেমিফাইনালে যাবার আশা ছিলো না। প্রথম ম্যাচে যুগোশ্লাভিয়ার কাছে হারলেও দ্বিতীয় ম্যাচে বলিভিয়াকে হারিয়ে দেয় ব্রাজিল। ব্রাজিল ও বলিভিয়া ম্যাচে উভয় দলের পোশাকের রঙ প্রায় একই থাকায় অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। পরে মধ্যবিরতির পরে বলিভিয়া তাদের পোশাক পরিবর্তন করে। উরুগুয়ে বিশ্বকাপে ব্রাজিল মোট ৫ টি গোল করে এবং ১টি গোল গ্রহন করে।

ইতালি বিশ্বকাপ (১৯৩৪)  দ্বিতীয় বিশ্বকাপে অংশগ্রহনকারী দল ছিল ব্রাজিলসহ ১৬টি। সেই বিশ্বকাপে ১৪ তম স্থান অর্জন করে দলটি। স্পেনের সাথে একটি ম্যাচে খেলে ঐ ম্যাচেই পরাজিত হয় ৩-১ গোলে। সেইসাথে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ থেকে বিদায় হয় তাদের।

ফ্রান্স বিশ্বকাপ (১৯৩৮) ১৯৩৮ সালেই হয় প্রথম বারের মত সেমিফাইনালে প্রবেশ করে ব্রাজিল দল। মোট ৫ ম্যাচে ৩ টি জয় নিয়ে তৃতীয় স্থান অধিকার করে ব্রাজিল। সেই ম্যাচে ১৪ টি গোল করেছে ব্রাজিল দল। সাতটি গোল টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ স্কোরার হন ব্রাজিল দলের ফরোয়ার্ড লিওনিদাস দা সিলভা। সেইসাথে তিন বিশ্বকাপে বেস্ট প্লেয়ার নির্বাচিত হন।

ব্রাজিল বিশ্বকাপ (১৯৫০) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রাজিলই সর্বপ্রথম বিশ্বকাপ আয়োজন করে। সেইসাথে ব্রাজিলের আয়োজিত প্রথম বিশ্বকাপও এটি। সেই বিশ্বকাপে রানার্সআপ হয় ব্রাজিল। উরুগুয়ের কাছে ২-১ গোলে পরাজিত হয় তারা। সেই বিশ্বকাপে ব্রাজিলে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন ব্রাজিলের এডিমির। ব্রাজিলের দেওয়া ২২ টি গোলের মধ্যে তার গোলই ছিল ৮টি। তাকে ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসের সেন্টার ফরোয়ার্ডদের মধ্যে বেষ্ট ধরা হয়। সেই বছর বিশ্বকাপের বেস্ট প্লেয়ার নির্বাচিত হন থমাস সোয়ারেস দা সিলভা বা জিজিনহো।

durbin-academy-blog

সুইজারল্যান্ড বিশ্বকাপ (১৯৫৪)  সুইজারল্যান্ড বিশ্বকাপে তিন ম্যাচে একটি জয় এবং সমান সংখ্যক ড্র এবং পরাজয় নিয়ে পঞ্চম স্থান অধিকার করে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বাড়ি ফেরে তারা।

সুইডেন বিশ্বকাপ (১৯৫৮)  সুইডেন বিশ্বকাপেই আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রথম বারের মতো বিশ্বকাপ জয় করে ব্রাজিল। সুইডেনকে ৫-২ গোলে পরাজিত করে তারা। সেই বিশ্বকাপেই উত্থান হয় ব্রাজিলের ফুটবলের ঈশ্বর খ্যাত পেলের। তিনি বেষ্ট ইয়ং প্লেয়ারের খেতাব অর্জন করেন আর বেষ্ট প্লেয়ার নির্বাচিত হন দিদি। মোট ছয় খেলার মধ্যে প্রতিপক্ষের জালে ষোলটি গোল দিয়ে পাঁচটি ম্যাচে জয়ী হয় তারা।

চিলি বিশ্বকাপ (১৯৬২)  চিলি বিশ্বকাপে  দ্বিতীয় বারের মতো বিশ্বকাপ ছোঁয়ার স্বাদ পায় ব্রাজিল। চেকোস্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে ৩-১ গোলে জয়ী হয় ব্রাজিল দল। সেই বিশ্বকাপে ব্রাজিল গোল করে মোট ১৪ টি। ৪ টি গোল করে বেষ্ট খেলোয়ার নির্বাচিত হন গ্যারিনচা। তাকে ফুটবল ইতিহাসের বেষ্ট ড্রিবলারদের মধ্যে অন্যতম মানা হয়। সেই বিশ্বকাপে পেলে করেন একটি গোল।

ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ (১৯৬৬)  সেই বিশ্বকাপে প্রথম পর্ব থেকেই বাদ যায় ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। ১ থেকে ১১ তম স্থানে নেমে আসে তারা। মোট তিনটি খেলার মধ্যে দুইটি পরাজিত হয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয় তারা।

মেক্সিকো বিশ্বকাপ (১৯৭০) পেলে নৈপুণ্যে তৃতীয় বারের মতো বিশ্বকাপে চুমো খাবার স্বাদ পায় ব্রাজিল। ফাইনালে তারা ইতালিকে হারায় ৪-১ গোলে। পুরো বিশ্বকাপে চারটি গোল করলেও অসাধারন খেলার জন্য বেষ্ট প্লেয়ার নির্বাচিত হন পেলে। ব্রাজিলের হয়ে সেই সাথে পেলেও তিনটি বিশ্বকাপে চুমো খাবার অসাধারন কৃতিত্ব অর্জন করেন।

ওয়েস্ট জার্মানি বিশ্বকাপ (১৯৭৪)  এই বিশ্বকাপে সেমিফাইনান পর্যন্ত যায় ব্রাজিল দল। মোট সাত খেলায় তিনটি জয়, দুইটি ড্র এবং সমান সংখ্যক হার নিয়ে চতুর্থ স্থান অর্জন করে ব্রাজিল। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে পোল্যান্ডের কাছে ০-১ গোলে পরাজিত হয় ব্রাজিল।

আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ (১৯৭৮)  এই বিশ্বকাপেই প্রথম বারের মত বিশ্বকাপ অর্জন করে ব্রাজিলের চির প্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনা। ব্রাজিল তৃতীয় স্থান দখল করে। সাতটি ম্যাচে ছিলো তাদের চারটি জয় এবং তিনটি ড্র।

স্পেন বিশ্বকাপ (১৯৮২)  স্পেন বিশ্বকাপে পঞ্চম স্থান অধিকার করে ব্রাজিল দল। মোট ৫ টি খেলায় ৪ টি জয় এবং ১ টি পরাজয় ছিলো তাদের। এই বিশ্বকাপেই প্রথম বারের মতো ব্রাজিল অর্জন করে ফেয়ার প্লে এওয়ার্ড। সেই বিশ্বকাপে ব্রাজিলের সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন ব্রাজিলের হোয়াইট পেলে খ্যাত জিকো।

মেক্সিকো বিশ্বকাপ (১৯৮৬)  দ্বিতীয় বারের মতো বিশ্বকাপের আয়োজক হয় মেক্সিকো। এই বিশ্বকাপে ব্রাজিলের অবস্থান ছিলো বেশ কিছুটা আগের বারের সাথেই মিল। এই বিশ্বকাপেও ফেয়ার প্লে এওয়ার্ড এবং পঞ্চম স্থান অর্জন করে ব্রাজিল। পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে চারটি জয় এবং একটি পরাজয়ের স্বাদ গ্রহন করে তারা।

ইতালি বিশ্বকাপ (১৯৯০)  ইতালি বিশ্বকাপে নবম স্থান অধিকার করে ব্রাজিল। চারটি ম্যাচে তিনটি জয় এবং একটি পরাজয় ছিলো তাদের।

যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপ (১৯৯৪)   ইতালি বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর আবারো ১৯৯৪ সালে জ্বলে উঠে ব্রাজিল। ১৯৭০ সালের পর চতুর্থ বারের চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। সেই বিশ্বকাপে তৃতীয় বারের মতো ফেয়ার প্লে এওয়ার্ড অর্জন করে ব্রাজিল। বেষ্ট প্লেয়ার নির্বাচিত হন ব্রাজিল দলের  অন্যতম সেরা স্টাইকার রোমারিও। ছয় ম্যাচের ছয়টিই জয় করে ব্রাজিল সেইসাথে প্রতিপক্ষের জাতে বল পাঠায় ১৯ বার। ব্রাজিলের হয়ে সর্বোচ্চ পাঁচ গোল করে রোমারিও।

ফ্রান্স বিশ্বকাপ (১৯৯৮)   ১৯৯৪ সালের পর আরেক বার ট্রফির স্বাদ পাবে পাবে করেও শেষ পর্যন্ত আর পাওয়া হয়ে ওঠেনি ব্রাজিলের। ফ্রান্সের সাথে ০-৩ গোলে হেরে রানার্স-আপ হয় তারা। ব্রাজিলের হয়ে সর্বোচ্চ চারটি গোল করেন রোনালদো। সেই সাথে তিনি বেষ্ট প্লেয়ার হবার খেতাব অর্জন করেন।

কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপ (২০০২)  ব্রাজিলের মাথায় আরো একবারের মতো মুকুট ওঠে কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপে। সেইসাথে ব্রাজিল হয়ে যায় বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ বিজয়ী। সেই রেকর্ড এখনো কোন দল ভাঙ্গতে পারেনি। ফাইনালে জার্মানিকে ০-২ গোলে পরাজিত করে ব্রাজিল। সেই বিশ্বকাপে ব্রাজিলের করা মোট ১৮ গোলের মধ্যে ৮ টি গোলই করেন রোনালদো। তিনি হন ঐ বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ স্কোরার।

durbin-academy-blog

জার্মানি বিশ্বকাপ (২০০৬)  জার্মানি বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বাড়ি ফেরে ব্রাজিল। পঞ্চম স্থান অধিকার করে ব্রাজিল। পাঁচ ম্যাচে চারটি জয় এবং একটি পরাজয় ছিল তাদের। সেই সাথে চতুর্থ বারের মতো ব্রাজিল দল স্পেনের সাথে যৌথ ভাবে ফেয়ার প্লে এওয়ার্ড ট্রফি অর্জন করে।

দক্ষিন আফ্রিকা বিশ্বকাপ (২০১০)  দক্ষিন আফ্রিকা বিশ্বকাপেও কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে বিদায় নেয় ব্রাজিল। পাঁচ ম্যাচে তিনটি জয় একটি পরাজয় এবং একটি ড্রয়ের স্বাদ গ্রহন করে তারা।

ব্রাজিল বিশ্বকাপ (২০১৪)  দ্বিতীয় বারের মতো বিশ্বকাপ আয়োজক হবার গৌরব অর্জন করে ব্রাজিল। সেই বিশ্বকাপে ব্রাজিল জার্মানির কাছে বাজেভাবে হেরে সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নেয়। যা কিনা ব্রাজিল সমর্থকদের জন্য এখনো দুঃস্বপ্নের মতো।

রাশিয়া বিশ্বকাপ (২০১৮)  রাশিয়ায় আয়োজিত বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন হবার অন্যতম দাবিদার ব্রাজিল। ব্রাজিল দলে আছে হালের ক্রেজ নেইমার। এই পর্যন্ত খেলা তিন ম্যাচে দুটি জয় এবং একটি ড্র নিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে শেষ ষোলতে গিয়েছে ব্রাজিল।

আরো কিছুঃ এই পর্যন্ত ব্রাজিল বিশ্বকাপে খেলেছে মোট ১০৭ টি ম্যাচ। জয় পেয়েছে ৭২ টি, ড্র হয়েছে ১৮ টি ম্যাচ (পেনাল্টি কিকের মাধ্যমে ফলাফল নির্ধারিত হওয়া ম্যাচগুলো ড্র হিসেবে ধরা হয়েছে) এবং পরাজয় বরণ করতে হয়েছে মোট ১৭টি ম্যাচে। যা কিনানা জয়ের তুলনায় খুবই নগন্য। বিশ্বকাপে প্রতিপক্ষের রক্ষনভাগ এফোঁড়-ওফোঁড় করে গোল হয়েছে ২২৬ টি এবং গোল হজম করতে হয়েছে ১০৩ টি।

পরিশেষে একবাক্যে বলা যায় ইংল্যান্ড ফুটবলের আবিষ্কারক আর ব্রাজিল পরিপূর্ণতাদানকারী এটিই চিরন্তন সত্য।

 

–মিথন ভৌমিক

durbin-academy-blog- mostishker dokkhota baranor upay
durbin-aca